নির্বাচনে শীতের প্রকোপ ও নিরাময়

0
506
  • অজয় দাশগুপ্ত
    নির্বাচন যখন শীতকালে হয় তখন নানা ঘটনায় ঋতুর প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে শীত যত গভীর হয় কিছু মানুষের মস্তিস্কে তখন ব্যামো দানা বাঁধে। শৈশবে আমাদের এলাকায় এমন দু একজন মানুষ দেখেছিলাম যাদের বিদ্যাবুদ্ধি এমনকি এককালে মেধা প্রখর থাকার পরও তাদের অভিভাবকেরা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতেন। তাদের বেফাঁস কথাবার্তা আর আচরণ সমাজ ও এলাকার জন্য কতটা অদরকারী বা ভয়ংকর ছিলো জানি না তবে তাদের বেলায় এমন দুর্ভাগ্য দেখেই বড় হয়েছি আমরা।

এখন নির্বাচনের আগে কত মানুষের কথা আর আচরণে এর চেয়ে ভয়াবহ বাস্তবতা । অথচ তাদের বেলাব নিয়ম পুরো উল্টো। তাদের বাঁধবে এমন বুকের পাটা আছে কারো? বরং তারাই স্বাভাবিক মানুষদের ধরে বেঁধে এনে শাস্তি দেয়। তাদের জায়গা মিডিয়ার পুরোভাগে। তাদের কথা শুনে জাতির দিনশুরু হয় তাদের কথাতেই ঘুমাতে যায় মানুষ।

এইদেশে এখনো জাতীয় ঐক্যমত্য বলে কোনকিছু গড়ে উঠলো না। বিশেষত এই বিজয়ের মাসে নেতারা যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস নিয়ে বাজে কথা বলেন আমরা শংকিত হই। আমাদের শংকা বা ভয়ে তাদের কিছু আসে যায় না। তারা দলবদল পালাবদল আর মুখ বদলে ব্যস্ত। একদা বাম নজরুল ইসলাম খান বললেন জামাত নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। যদি তার এই কথাটা মানি তাহলে তাহলে কার সাথে যুদ্ধ হয়েছিল আমাদের? পাকহানাদার বাহিনীকে কারা পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো গ্রাম-গ্রামান্তরে? সেই মরুভূমি পাঞ্জাব বেলুচিস্তান বা সিন্ধু থেকে আসা পাকবাহিনী নৌকা চিনতো না। নদী কি জানতো না, তাদের রাস্তাঘাট দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া দালাল ছিলো কারা? কারা গড়েছিল শান্তিবাহিনী? কাদের নির্দেশে, কাদের চিনিয়ে দেয়ার কারণে দেশ হারিয়েছিল তার সোনার সন্তানদের? এসব তথ্য খান সাহেবের অজানা না। জেনে বুঝেই বলেছেন তিনি। হয়তো শীতের প্রকোপ। নয়তো ধান্দাবাজী।

তিনিতো নস্যি। আমাদের রাজনীতিতে আরো আগে প্রলাপ বকতে শুরু করা বঙ্গবীর নামে খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী আরো এক পা এগিয়ে। এই ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে খেতাব পেয়েছিলেন। এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে বিজয়ের শুরুতেই গোটা দেশকে ফেলে দিয়েছিলেন বিপাকে। অতি উৎসাহে খোলা মাঠে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রাজাকার দালাল হত্যাকারী তার কারনে বিদেশী মিডিয়ার তোপের মুখে পড়েছিল সদ্য স্বাধীন স্বদেশ। সে পরিস্হিতি সামাল দিয়েছিলেন তাজ উদ্দীনের প্রজ্ঞা। সে লোকটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবনে ততদিন গোশত খাবেন না, যতদিন জাতির জনক হত্যার বিচার না হবে। সে শপথ ভঙ্গ করেছিলেন বিচার ও শাস্তির আগেই। এমনই ডাবল ষ্ট্যান্ডার্ড।

আমাদের মিডিয়াতেও শীতের প্রকোপ আছে। সর্বাধিক জনপ্রিয় বা চালু বলে প্রচলিত যে দৈনিক তার বিরুদ্ধে টেন্ডার জয় করে কাজ করার আগে টাকা চুরির অভিযোগে জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল সে তারাই আজ তার বন্দনায় পঞ্চমুখ। বুঝি না কিভাবে এই যোদ্ধা নিজের অতীত আর সংগ্রামী ইতিহাসকে এভাবে অবমাননা করেন। পাগলামী ছাড়া এই কাজ অসম্ভব।

পালের বর্তমান গোদা ডক্টর সাহেবও কম যান না। তাঁর কথামতো পাকিস্তানের কারাগারে থাকা মানুষটি এখন উল্টাপাল্টা বকছেন। রাজনীতিতে দলবদল অস্বাভাবিক কিছু না। বরং সেটাই দস্তুর। কিন্তু খোল নলচে বদলে তা করতে হবে কেন? বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ইতিহাসকে সম্মান করে বা তার দিকে থেকেও আওয়ামী বিরোধিতা করা যায়। সেটা তাঁরা করছেন না। তাদের টার্গেট একটাই। বঙ্গবন্ধু কন্যার অপসারণ। শীতকালে জেগে ওঠা মানুষের এমন খায়েশ থাকতেই পারে। কিন্তু তারপর? সে তারপরটা ক্লিয়ার না। বাংলাদেশ এখন চাইলেই যেকোন ঝুঁকি নিতে পারে না। তার ষোলকোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলাও সহজ না । কারণ মানুষ সব জানে আর বোঝে।

ভোটটা যেহেতু শীতকালে আমরা ভয় পাবো এটাই স্বাভাবিক। মানুষের ভেতরও ঋতুর প্রভাব আছে। কারা যে কখন কোনদিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। সাধারণ নির্বাচনে আমজনতাই ভোটার। এই আমজনতা বিষয়টাও গোলমেলে। আপনি যদি দুনিয়ার ইতিহাস দেখেন জানবেন আমজনতাকে জিজ্ঞেস করে না কোনকালে বড় কিছু হয়নি। করা যায়ও না। তাদের সমর্থন লাগে বৈকি। তবে বড় কাজ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। যেটা মধ্যবিত্ত বা সাধারণেরা পারেন না। এটাই নিয়ম। সে নিয়মের কারণেই সবদেশে বা অগ্রসর সমাজে কিছু মানুষ সামনে থেকে পথ দেখায়। সে মানুষদের সবাই পছন্দ করবে এমন না। বরং তাদের সমালোচনা আর নিন্দাই হবে বেশী। যে যত বেশী কাজ করে তার সমালোচনা ততোধিক। ফলে সমালোচনার বাইরে গিয়ে পছন্দ করার সময় এখন দুয়ারে। এর জন্য যাদের সমর্থন আর সহযোগিতা দরকার তাদের ভেতর আছে শীতকালীন সুবিধাবাদ। এরা গ্রীস্মের ওয়াজ করেন শীতকালে আর গ্রীস্মকালে গান শীতের কীর্তন। কিভাবে যে কি হবে তার চিন্তাতেই কেটে যাবে বিজয়ের এই মাস।

তারামন বিবি প্রয়াত হবার দিন বেছে নিলেন ডিসেম্বরের এক তারিখ। এর একটা তাৎপর্য আছে নিশ্চয়ই। মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের সোনার সন্তান। তারা ছিলেন বলেই- আমাদের মাথা উঁচু। আমাদের বুক স্ফীত। তারামন বিবি সব হারিয়েছিলেন শুধু সাহস আর আশা হারান নি। আমরা যদি তাঁকে শ্রদ্ধা করি বা ভালোবাসি তবে আমাদের উচিৎ নয় আশাহীন হওয়া। হতাশা না দেয় আয়ু না কোন সম্ভাবনা। এদেশের তরুণ প্রজন্ম যেন বিভ্রান্ত না হয় যেন তাদের জীবন নানা সংঘাতে দীর্ন না হয় সে চিন্তা এখনই করতে হবে। সম্প্রতি নানা অজুহাতে তাদের রাগিয়ে দেয়া আর মাঠে নামানোর কুফল দেখা গেছে। যে বাস্তবতা তৈরী হয়েছিল সরকারী দলের কিছু নেতার কারণে। সে কারনে সরকারী দলে যাদের শীতের প্রকোপ আছে তাদের কথা মাথায় রাখা দরকার। এরা মানুষকে রাগিয়ে তোলা ছাড়া আর কি কাজে আসেন?

নির্বাচন যত ঘনীভূত হবে তত আরো জটিলতা আর কুয়াশা তৈরী হবে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প নাই। আবার রাজনীতিতে আমজনতার ভোট ও মূল্যবান । এ দুই সত্যের ভেতর সেতুবন্ধন তৈরী হয়নি। সেখানেই ভয়। দেশ জাতি ও ভবিষ্যত নিরাপদ করতে হলে শীতকালে সুস্থ থাকা সঠিক রাজনীতি ও পথ বেছে নেয়ার বিকল্প নাই।

এবারের নির্বাচন আমাদের ভয় ও আশংকাকে দূর করে একটা গঠনমূলক বিরোধীদল ও সরকার উপহার দিক। হানাহানি বিদ্বেষ বা সংগাতের বাইরে তৈরী হোক জাতীয় ঐক্য। যা না থাকলে বছরের পর বছর কেবল হিংসা আর মারামারি বা চক্রান্তই রাজত্ব করবে। তেমন কিছু চাইনি বলেই মুক্তিযুদ্ধে দেশ মুক্ত হয়েছিল। সে ত্যাগ আর আত্মদান যেন দম্ভ বা ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত না হয়। বিজয়ের মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক পরিচিতি: সিডনি প্রবাসী, লেখক কবি ও কলামিস্ট

আজসারাবেলা/কলাম/ভোটের-হাওয়া/রই