মেয়েরা বাইক চালালে অসুবিধা কি সমাজের?

0
2413
  • শাহিনারা জেসমিন
    ছোট্ট একটি খবর, ‘খিলক্ষেতে সড়ক দুর্ঘটনায় বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এক তরুণী নিহত’। কি পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা খবরে উল্লেখ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীর কোন বক্তব্য নেই। মনে পড়ে গেল, ২৪ বছর আগের একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কথা।

সেদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স সম্পন্ন করা রিতা তার ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলে জয়পুরহাট থেকে নওগাঁ রওনা হয়, নতুন কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য। হালকা রিতা এক রাশ স্বপ্ন নিয়ে চলেছে নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে কিন্তু বিধিবাম, দ্রুত গতিতে ছুটে চলা বাস ট্রাকগুলো বিকট হর্ণ বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে থাকে। এক সময় একটি ট্রাক ওদের মোটরসাইকেলটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার মুর্হূতে বিকট শব্দ করে আচমকা হর্ন বাজায়।

তীব্র আওয়াজে সে ভয়ে চমকে উঠে মোটরসাইকেল থেকে মাটিতে পড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আশপাশের লোকজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে, হতভম্ব ভাইটি বাইক থামিয়ে দেখে বোনের নিথর দেহটি রাস্তায় পড়ে আছে। সবাই মিলে তাকে দ্রুত হসপিটালে নেয়া হয়। কিন্তু রিতার জ্ঞান আর ফেরানো যায়নি। এক রাশ অপূর্ণ স¦প্ন নিয়ে মেয়েটি পাড়ি দেয় না ফেরার দেশে।

রাস্তায় মেয়েদের বাইক চালাতে দেখলে বা কোন বাইকের পেছনে মেয়ে আরোহী দেখলে অনেক বাস ট্রাকের ড্রাইভাররা তাদেরকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য নানা ধরনের অদ্ভূত আচরণ করে থাকে।

অথচ পুরুষ চালকরা আরোহী দেখলে তারা এধরনের আচরণ করে না।

আমি নিজে যখন বাইক চালিয়েছি বা আরোহী হয়েছি, তখন ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছি। হাইওয়েতে বাইক চালানোর সময় নিরাপত্তার জন্য আমি সাধারণত বড় বাস বা ট্রাক দেখলে রাস্তার পাশে বাইক থামিয়ে দাঁড়াতাম অথবা রাস্তার পাশে জায়গা থাকলে সে দিকে ধীর গতিতে চালাতাম। অথচ বাস এবং ট্রাকগুলো আমাকে অতিক্রম করার সময় কোন কারণ ছাড়াই হর্ন বাজিয়ে যেত।

এমনও দেখেছি, বাসটিকে নিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে যেতে মনে হয় বাসটি ধাক্কা দিয়ে চলে যাবে। মেয়েদের চমকে যাওয়া বা ভয় পাওয়াটাই তাদের ভাললাগার কারণ।

ভাবটা এমন- ‘মেয়ে মানুষ আবার বাইক চালায়, সাহস কত একটু পরখ করে দেখিতো!’ কেন মেয়েরা মোটর বাইক চালাবে? কেন তারা বাইকে চড়বে? রিক্সাতে চড়ার সময়ে কেন তারা হুড না তুলে বসবে? একসময় দেখা যেত, রিক্সাতে নারী আরোহী থাকলে শাড়ি দিয়ে পেচিয়ে পর্দা করা হতো।

সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। গ্রামে এনজিওতে র্কমরত নারীরা সাধারণত মোটরবাইক চালিয়ে দূরদূরান্তে ছুটে চলেন। দুর্গম এলাকায় কাজ করেন। গ্রামবাসীরা তাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।

দেশ এখন এগিয়ে গেছে, মেয়েরা এখন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশবাহিনী এমনকি ট্রাফিক পুলিশেও কাজ করছে কিন্তু এতে পুরুষদের মানসিকতার কি খুব বেশি পরির্বতন হয়েছে?

সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি দেখে কিন্তু তা মনে হয় না। খোদ রাজধানীতে একজন নারীবাইক চালক নাজেহাল হয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের হাতে। গুনধর ট্রাফিক পুলিশ শুধু তাকে নাজেহাল করেই ক্ষান্ত হননি, মনের জ্বালা মেটাতে বাস ড্রাইভারকে বলেছেন বাইকটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। খুশিতে গদগদ ড্রাইভারটি ধাক্কা দেয়ার অনুমতি পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত এবং আজ্ঞা পালনে সে আর দেরি করেনি। গণপরিবহনের স্বল্পতার জন্য ইদানীং রাজধানীতে গুটি কয়েকজন নারীকে বাইক চালাতে দেখা যায়।

নারীবিষয়ক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাস্তায় প্রতিনিয়ত মেয়েদের হেনস্তা ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। পথ চলতে অসহযোগিতার শিকার হন। নারী চালকরা মনে করেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মেয়েরা দৈনন্দিন কাজে পুরুষের পাশাপাশি মোটরবাইক ব্যবহার করছেন কিন্তু এখানে এই সংখ্যা কম হওয়ায় নারী চালকদের দেখতে এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি পুরুষ ও সমাজ। আরও বেশি সংখ্যক নারীরা যখন মোটরবাইক চালাবেন, তখন হয়ত দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটবে। ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকার গ্রাম ও শহরে সাইকেল ও মোটরসাইকেলের ব্যবহার সেখানকার নারীদের কর্মক্ষেত্রে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।

একজন নারী বাইক চালানোর অর্থ কিন্তু তার ঔদ্ধত বা উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ করে না। গণপরিবহনে প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার নারীদের নিরাপদে কর্মস্থলে যাবার জন্য বিকল্প যানবাহন বা নিজস্ব যানবাহন ব্যবহার করতে হয়। ছোট শিশু বা কিশোরী মেয়েকে স্কুলে বা কোচিংয়ে নেবার জন্য মা বা বড় বোনকেই ছুটতে হয়। মোটরবাইকের ব্যবহার তাই অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু পথে ঘাটে যদি হেনস্থার শিকার হন তবে তা দুঃখজনক।

একটি বাহন কখনোই শুধুমাত্র নারীর বা পুরুষের ব্যবহারের জন্য তৈরি হয় না, প্রয়োজনে নারী পুরুষ উভয়েই তা ব্যবহার করতে পারে এটা ভাবতে হবে। আমরা যদি নারীদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে না পারি তবে পথে ঘাটে নারী বাইক চালক বা আরোহীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর বাড়তেই থাকবে। তাই সবার সহযোগিতামূলক মনোভাবই পারে সমাজে নারী পুরুষের সমতা বজায় রেখে সামনের এদিকে এগিয়ে দিতে।

পরিচিতি: এনজওি কর্মকর্তা।