জলে যার প্রতিবিম্ব : আরেক ভ্রান্তি বিলাস

0
271
  • মোহাম্মাদ সেতাব উদ্দিন
    সম্পাদনা রাহাত খান। তাঁরই ভাষায় ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক জেমস জে. নোভাক’ রচিত ‘বাংলাদেশঃ জলে যার প্রতিবিম্ব’ বইটি যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশঃ ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশ করে ১৯৯৩ সালে । বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের সহায়তায় এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।

বইটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন। এতে অনেক ডাহা মিথ্যা তথ্য কাঁচা হাতে সন্নিবেশিত হয়েছে যা পাকিস্তানের দালালরা মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে এবং পরাজিত মার্কিন প্রেতাত্মারা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার করেছে। কোন ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি বইটি পড়ে জেমস জে. নোভাক কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক হিসেবে ভাবতে পারবেন কিনা সন্দেহ! তিনি এমনও অনেক মিথ্যা তথ্য তার এই বইতে সন্নিবেশিত করেছেন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা মুখে মুখে প্রচার করত! কোন তথ্যানুসন্ধান ছাড়াই, খোঁজ খবর না করেই অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই তিনি লোকের মুখের মিথ্যা কথাগুল লিখে দিয়েছেন!

বঙ্গবন্ধুর মত এত বড় রাজনীতিবিদের আকাশচুম্বী উচ্চতা সম্পর্কে নোভাকের হয় কোন ধারনাই ছিল না অথবা সচেতনভাবেই বাঙালির মহান নেতাকে হেয় করার মনোবৃত্তি নিয়ে তার এই রচনা ।

বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক এবং রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ নোভাক যে কোনো প্রখ্যাত লেখক হতে পারে না। বরং তিনি মার্কিন সরকারের নিম্ন মানের দালাল- তা তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। তৎকালীন মার্কিন সেক্রেটারি অব ষ্টেট হেনরি কিসিঞ্জার যেমন পরাজয়ের জ্বালা প্রশমিত করতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল তেমনি নোভাক মার্কিন সরকারের দালালি করতে গিয়ে বলছেন- ‘ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) বৌদ্ধিক অলসতা, যা তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট ছিল; তাঁর ভেতরের শত্রু হয়ে ওঠে। তিনি অর্থায়ন, বৈদেশিক সাহায্য, বাণিজ্য, বৈদেশিক সম্পর্ক, আইন, মতাদর্শ, ইতিহাস কিছুই বুঝতেন না’।

পাঠক লক্ষ্য করুন- যে রাজনীতিবিদ তাঁর মেধা, অসাধারন চিন্তা চেতনা এবং তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির হোমরাচোমরাদের কিসিঞ্জারসহ জুলফিকার আলি ভুট্টোকেও ঘোল খাইয়ে দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন তিনি নাকি আইন, বৈদেশিক সম্পর্ক, ইতিহাস কিছুই বুঝতেন না! বৈদেশিক সম্পর্ক এবং ইতিহাস যদি নাই বুঝতেন তাহলে মাত্র দু’বছরের মধ্যে সমগ্র বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের এত গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠল কী করে?

বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কেবল মাত্র চীন এবং সৌদি আরবের সাথে সেই দুই বছরে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং নোংরা রাজনীতিই ছিল দায়ী। মার্কিন জনগণ আমাদের পক্ষে থাকলেও সরকার বৈরি থাকায় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে আইএসআই-এর পক্ষে একাট্টা হয়ে সিআইএ জাতীয়তাবাদী মুজিব সরকারকে অকার্যকর করতে হেন অপকর্ম নাই যা করেনি!

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সাহায্যের নামে বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে ছদ্মবেশে এদেশে মার্কিন গোয়েন্দাদের অনুপ্রবেশ ঘটে! মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এরা খুবই সন্তর্পনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন এবং দলীয় নেতাকর্মীর নামে কুৎসা রটাতে সচেষ্ট হয়! প্রচুর অর্থের বিনিময়ে একাজে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’কে বেছে নেয়। সাথে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কয়েকটি ভুঁইফোড় পত্রিকাও যোগ দেয়। দুরভিসন্ধিমূলক এই অপপ্রচারে স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বানন্দে অংশগ্রহণ করে।

মার্কিন চক্রান্তের অন্তর্জাল সমগ্র দেশে বিস্তৃত হয়ে পড়ে! সদ্যজাত এবং স্বভাবতই অরক্ষিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সিআইএ, আইএসআই এবং চাইনিজ গোয়ন্দারা সংঘবদ্ধ হয়ে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট এনজিও’র মাধ্যমে শেখ মুজিব, তার পরিবারের সদস্য এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। ঘটনা প্রবাহ ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।

খুবই সন্তর্পণে আইএসআই- এর নেতৃত্বে প্রথমত এরা সেনাবাহিনীর ভেতর অসন্তোষ এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। কারণ, তাদের নিজের হাতে গড়া সেনাবাহিনীর মন মানসিকতা তারা ভালই জানত। তাই পাকিস্তানি ভাবধারায়-পুষ্ট সেনা কর্মকর্তারা জাতীয় রক্ষীবাহিনীর টোপ দেয়া মাত্র গিলে ফেলল! বলা হল- ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধ্বংস করতে ভারতীয় পরিকল্পনার অংশ এই জাতীয় রক্ষীবাহিনী। এদের বাজেট বেশি, সুযোগ-সুবিধা বেশি। সেনাবাহিনীর চেয়েও ভারী অস্ত্রসস্ত্র এদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

তখনও পাকিস্তানে গড়ে ওঠা ৯০% সেনা কর্মকর্তারা ভারত নামটি সহ্য করতে পারেত না। ধারণা করা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রণের পর এদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে।কিন্তু না সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থিক অনটন কিম্বা অভাব এরা সহ্য করতে নারাজ।

তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্রলীগের একটি অংশকে অর্থলোভ দেখিয়ে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়! তখন এদের হাতে চাইনিজ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পাওয়া যায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ভগ্নস্তূপের মধ্য থেকে যুদ্ধবিধবস্থ দেশকে টেনে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেন। কিন্তু শক্তিধর চক্রান্তকারী এবং স্বাধীনতার শত্রুদের অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে।

অবশ্য আজ এতদিন পরে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ং পাকিস্তানের আইএসআই’কে একটি জঙ্গি সংগঠন বলছে!

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক,বাংলাদেশ বেতার।

আজসারাবেলা/সংবাদ/রই/মতামত

 

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here