সাগুফতা নেওয়াজ। চেয়ারম্যান, এনটুএন সোর্সিং লি.। মেয়েদের শত প্রতিকূলতার মাঝেও জ্বলে ওঠার দারুণ এক উদাহরণ তিনি। প্রবল ইচ্ছা, অধ্যাবসায়, সততা আর মেধা মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। কথা বলায় স্পষ্ট, উচ্চারণে সাহসী; বলতে শুরু করলেন তার সফলতার গল্প। যে পেশায় মেয়েদের উপস্থিতি অপ্রতুল, সেই পেশায় নিজেকে নিয়ে গেছেন ইর্ষণীয় উচ্চতায়। ভালোবাসেন কবিতা, এক সময় করতেন বিতর্ক। সেই সাগুফতা এখন অনেক ব্যবসায়ী মেয়েদের কাছে আলো আর আদর্শ। সারাবেলা জানতে চেয়েছিল তার ‘লাইট হাউজ’ হওয়ার জার্নিটা কেমন ছিল?
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন ও রবিউল ইসলাম।
আজ সারাবেলা: তৈরী পোশাক শিল্পের বাজার নিয়ে আপনি কাজ করছেন অনেকদিন। কোভিড পরিস্থিতি সব ট্রেডকেই পর্যুদস্ত করেছে। তৈরী পোশাক শিল্পের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বাস্তবিক অর্থে কেমন?
সাগুফতা নেওয়াজ: এই মুহুর্তের পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। ৭/৮ মাস আগেও ফ্যাক্টিরিগুলোতে অর্ডার ছিল না। এখন প্রচুর অর্ডার আমরা পাচ্ছি। মার্কেট-ফ্লো ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সুতার প্রাইজিংয়ে। এটা স্ট্যাবল না। আমাদের একটা অর্ডার প্রসেস করতে করতে সময় লেগে যায়। দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে সুতার দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে সমস্যা তৈরী হয়। আমি নিজেই প্রচুর কাজ পাচ্ছি সব কিছু মিলিয়ে বলবো পরিস্থিতি ভালো।
আজ সারাবেলা: আপনারা এখন কোন কোন ব্র্যান্ড বা কাদের কাজ করছেন?
সাগুফতা নেওয়াজ: এই মুহুর্তে আমি স্পেন, পর্তূগাল, ডেনমার্ক আর ভিয়েতনামের বায়ারদের সঙ্গে কাজ করছি। কিছু দিন আগে সুতার দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমেরিকার অর্ডার মিস করেছি। পরে অবশ্য তাদের আরেকটি কাজ পেয়েছি। মূলত, আমার বেশি কাজ করা হয় ইউরোপের সঙ্গে। ইউএসএ’র মার্কেটেও প্রচুর কাজের রেসপন্স আছে।
আজ সারাবেলা: ব্যাবসার কাজে আপনাকে প্রচুর ট্রাভেল করতে হয়। একজন নারী হিসেবে পরিবার এবং ব্যাবসা সবকিছু সামলান কীভাবে?
সাগুফতা নেওয়াজ: আলহামদুলিল্লাহ আমি খুব ভালো একজন স্বামী পেয়েছি। বিবাহিত মেয়েদের জন্য হাজব্যান্ডের সাপোর্ট অনেক জরুরি। সে কর্মজীবীই হোক বা গৃহিণীই হোক। আমার হাজব্যান্ড আসিফ নেওয়াজ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে কর্মরত। তিনি সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। গার্মেন্টস ট্রেডে অনেক সময় দিতে হয়। আমাদের দুই সন্তান। এমনও সময় গিয়েছে রাত বারোটায় মিটিং শেষে বাসায় ফিরেছি। আমার হাজব্যান্ড রান্না করে রেখেছে। তার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আমরা যৌথ পরিবারেই থেকেছি। সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে।
এমনকি আমার শাশুড়ি যদি কখনো বাইরে থাকেন ফোন করে প্রথমেই জানতে চান- ব্যবসার খবর কি? শ্বশুড়-শাশুড়ি দুজনই ইকোনোমিকসে মাস্টার্স। তারা সব সময়ই আমাকে এগিয়ে দিতে চেয়েছেন। আমি ভিকারুননিসা থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল হিস্ট্রি’তে মাস্টার্স করেছি। আমার বাবা, আমার ভাই তারাও এগিয়ে যাওয়ায় অনেক বড় অনুপ্রেরণা।
আজ সারাবেলা: আপনাকে-তো বিদেশিদের সঙ্গেই সব সময় কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের নারীরা অনেক বেশি নির্যাতিত-নিপীড়িত এমন ধারনাই বাইরের দেশে প্রচলিত। বাংলাদেশের নারী হিসেবে তারা আপনাকে কীভাবে দেখেন?
সাগুফতা নেওয়াজ: দেখুন, প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব্যই তার পরিচয়। আমাদের নারীদের সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারনা আছে একথা সত্য। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য- বাংলাদেশের মেয়েরা শ্রম, মেধা এবং যোগ্যতা দিয়ে দেশে-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে কাজ করছে। আমি আট মাসের প্রেগনেন্ট অবস্থায় বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে মিটিং করেছি, তারা অবাক হয়েছে। করেছি কারণ, আমি কাজটা হারাতে চাইনি। কাজটা হারালে আমার দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে- এভাবেই চিন্তা করেছি।
আজ সারাবেলা: সফলতা আপনাকে ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু এই সাফল্য একদিনে আসেনি। হয়তো ভাবেনওনি এতটা সফলতার সঙ্গে কাজ করবেন। শুরুর দিকের অমসৃণ পথ চলার গল্পটা যদি শেয়ার করেন।
সাগুফতা নেওয়াজ: শুরু থেকেই বিজনেসের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। কিন্তু কীভাবে কোথা থেকে শুরু করবো তা জানা ছিল না। অভিজ্ঞতার জন্য একটা ফরওর্ডায়িং কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু লজিস্টিক ট্রেড খুব একটা ভালো লাগেনি। নিজে কিছু করার আগ্রহ ভেতরে ভেতরে প্রবল হতে থাকে। এরই মধ্যে আমার সিভি যায় গার্মেন্টস ট্রেডের একটা ফরাসি কোম্পানিতে। সেখানে জব করলাম, যেটা পরবর্তীতে প্যাক্সা’র সঙ্গে মার্জ করলো। প্যাক্সা ওয়ার্ল্ডওয়াড একটা বড় প্রতিষ্ঠান। একটা বড় অভিজ্ঞতা হয় সেখান থেকে। পরে একটা জার্মান কোম্পানিতে কান্ট্রি হেড হিসেবে জয়েন করার সুযোগ হয়। ট্রেডিংয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু যে জার্মান ভদ্রলোক এসেছিলেন ইন্টারভিউ নিতে, তিনি বলেছিলেন- তোমার মধ্যে যে কনফিডেন্ট দেখেছি তাতে মনে হয়েছে তুমি পারবে। শুরু হলো আমার নতুন এক যাত্রা।
জামার্ন যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি আমার কাজের রিভিউ নিতে প্রথমে ৩ মাস পর পর দেশে আসতেন। পরে বছরে দু’বার আসতেন। ধীরে ধীরে আমার প্রতি আস্থা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আমি নিজেই সবকিছু ডিল করি। একাউন্টস, ফ্যাক্টরি এভরিথিং। এর মধ্যে আমার হাজব্যান্ড একদিন আমাকে পরামর্শ দেয়, তুমি নিজেই একটি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারো। আমি নিজেও চাচ্ছিলাম নিজের আইডিয়াগুলো নিজের মতো করে কাজে লাগাই। চাকরিরত অবস্থায় ব্যবসার জার্নিটা শুরু করি। কিন্তু নিজের মনের কাছে, নৈতিকতার কাছে আটকে যাই- কোন পরিচয়টা ব্যবহার করবো ক্লায়েন্টদের কাছে। চাকরির না নিজের ব্যবসার। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম চাকরি ছাড়ার। শতভাগ দিয়ে নিজের ব্যবসাতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলাম।
আজ সারাবেলা: আপনার ব্যবসার শুরু ২০০৯ সালে। এখন ২০২২-এ এসে আরএমজি সেক্টরে কী পরিবর্তন দেখছেন?
সাগুফতা নেওয়াজ: গুণগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর বড় একটি কারণ, সেকেন্ড জেনারেশন যারা আছে তারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে এই ট্রেডে এসেছে। আগে গার্মেন্টস ট্রেড বিষয়ে যে পড়াশোনা ছিল তা অপ্রতুল। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশাশি বিজিএমইএ’র ভূমিকাও অনেক। এখন ফ্যাশন ডিজাইনিং, মার্চেন্টডাইজিং, টেক্সটাইল বিষয়ে পড়াশোনা করে আসছে নতুনরা। অনেক টাকা দিয়ে ইন্ডিয়ান বা শ্রীলঙ্কানদের নিয়ে আসার যে প্রবনতা ছিল তাও অনেকটা কমে এসেছে। লোকে এখন এই ট্রেডটাকে সম্মানের চোখে দেখে। এই সবই ইতিবাচক পরিবর্তন।
আজ সারাবেলা: এই ট্রেডে কিছু অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। শিপমেন্টে সমস্যা, পেমেন্ট আটকে যাওয়া, ডিসকাউন্ট চাওয়া- আপনার অভিমত কি?
সাগুফতা নেওয়াজ: এখানে বায়িং হাইজ এবং ফ্যাক্টরির মধ্যে দায়িত্বের কিছু টানাপোড়ন ঘটে যা অনাকাঙ্খিত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক অনেক কিছুই ঘটে যা অনভিপ্রেত। পাশাপাশি শ্রমিক সংকট, র-মেটেরিয়ালের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু যত যাই ঘটুক, মনে রাখতে হবে এক্সপোর্ট করছে কিন্তু ফ্যাক্টরি। বায়িং হাউজ এককভাবে কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার জন্য দায়ী নয়। শিপমেন্টের দেরি হলে সেটা সবার জন্যই সমস্যা। সে জন্য বায়িং হাইজকে দোষারোপ করা যাবে না। যে বা যার মাধ্যমে ব্যবসা আসছে তাকে ভোগানো কখনই ইতিবাচক ফল দেবে না। মূল জিনিস হচ্ছে অর্ডার। সেটা মিস বা ক্যান্সেল হলে কারো জন্যই ফলপ্রসু নয়। দু’জনেই যেন উইন-উইন সিচ্যুয়েশন থাকে- এটা মাথায় রাখতে হবে।
আজ সারাবেলা: কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিকে গতিশীল করবার লক্ষ্যে সরকার আরএমজি সেক্টরে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। বায়িং হাউজগুলো এর আওতায় নেই। আপনারা সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করেন?
সাগুফতা নেওয়াজ: কোভিড পরিস্থিতিতে যখন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছু বন্ধ তখনও আমরা অফিস পরিচালনা করেছি। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাটাই করেছে। বেতন-ভাতা বন্ধ রেখেছিল অনেকে। অনেকে দিয়েছে অর্ধেক। সেই পরিস্থিতিতেও আমরা পূর্ণাঙ্গ বেতন-বোনাস দিয়ে অফিস চালিয়েছি। একজন কর্মীকেও ছাটাই করিনি। নিজে কষ্ট করে হলেও চালিয়ে নিয়েছি। সরকার যদি বায়িং হাউজগুলোর প্রতিও দৃষ্টি দেয় তাহলে এই শিল্প আরো এগিয়ে যাবে, প্রণোদিত হবে।
আজ সারাবেলা: আপনি অনেকদিন ধরেই এই ট্রেডে কাজ করছেন। বায়িং হাউজগুলোর স্বার্থ-সুরক্ষা নিয়ে কোনো ধরনের সংগঠন বা ফোরাম করার পরিকল্পনা আছে কি না?
সাগুফতা নেওয়াজ: কাজের স্বার্থে, দেশের স্বাথেই বায়িং হাউজের স্বার্থ-সুরক্ষা প্রয়োজন। কেননা কাজ হারালে আল্টিমেটলি দেশের ক্ষতি, অর্থনীতির ক্ষতি। সবার মধ্যেই একটা ইউনিটি প্রয়োজন। তখন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জায়গা তৈরী হবে, বেরিয়ে আসবে সমাধানও। আমি বিজিবিএ’র সদস্য। একটা বিষয় লক্ষণীয়, এই ট্রেডে ফ্রন্ট লাইনে মেয়েরা খুব কম। হয়তো আছে কিন্তু পেছনের সারিতে। অথচ সুইং কিন্তু এই মেয়েরাই করছে। যেখান থেকে এই ট্রেডের শুরু। আমি চাই টপ পজিশনগুলোতে মেয়েরা আরও এগিয়ে আসুক।
আজ সারাবেলা: আপনি চান মেয়েরা এগিয়ে আসুক। টপ পজিশনে যাক। আপনি বিদেশি মুদ্রায় অনেক টাকা উপার্জন করেন। হয়তো ওডি বা মার্সিডিজে চড়েন। কিন্তু কেমন লাগে, যখন আপনার পাশ দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে কোনো এক গার্মেন্টসের মেয়ে হেটে যায়। যার বেতন হয়তো ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এ শহরে যার হয়তো জীবন সংগ্রামে হিমশিম খেতে হয়। তখন কেমন লাগে আপনার?
সাগুফতা নেওয়াজ: এটা আমাকেও খুব কষ্ট দেয়। তবে কেনো কাজকেই আমি ছোট করে দেখি না। তাদের শ্রমেই আজকে এই ইন্ড্রাস্টি দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো শিক্ষা এবং সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে এই মেয়েরা আরো ভালো কাজ করবে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমাদের মেয়েরা কষ্টে না পড়লে শেখে না, কাজে আসতে চায় না। কিন্তু তার যে যোগ্যতা, ক্ষমতা আছে সেটা তাকে বুঝতে হবে। নিজের সম্মান আর পরিচয়ের জন্যই মেয়েদের কাজ করতে হবে। প্রতিটি মানুষই অসীম সম্ভাবনাময়। তাই প্রতিটি মানুষ আর তার কাজকে সম্মান করতে হবে সকলকেই।
আজসারাবেলা/সংবাদ/রই/সাক্ষাৎকার