প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান হেলাল:
২১ ফেব্রুয়ারি এখন মাতৃভাষা দিবস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার আরও কত নাম না-জানা শহীদের আত্মত্যাগেই পেয়েছি আমাদের প্রাণের ভাষা ‘বাংলা’। ১৯৪৮ থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আমাদের রক্তস্নাত বর্ণমালার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক সংগ্রামে এক স্বাপ্নিক কারিগর হিসেবেই ইতিহাসে স্থান- সর্বকালের এই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির। যে ভাষার জন্য এমন আকুল হয়েছিল বাঙালি, ঢেলে দিয়েছিলো বুকের তাজা রক্ত, সেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাংলা ও পাঞ্জাবকে দুই ভাগ করে ভারত-পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রের জন্ম তথা দেশভাগ হলে, সে বছরেরই ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয়েছিল প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। অবিভক্ত বাংলাকে এই ভাবে দুই টুকরো করার বেদনা তরুণ শেখ মুজিব মেনে নিতে পারেননি। তাই কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেই তিনি অবিভক্ত বাংলার রাজনীতি থেকে পূর্ববাংলার নিজস্ব রাজনীতি নির্মাণে মনোনিবেশ করেছিলেন। ফলে দেশভাগের ঠিক পরের বছরই তিনি অছাত্র ও এলিটদের নিয়ন্ত্রিত ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক ধারায় সক্রিয় ছাত্রনেতাদের নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। ঠিক পরের মাসেই, ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে সব মুসলিম লীগ সদস্য সমর্থন দেয়। এর প্রতিবাদে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে। ফজলুল হক মুসলিম হলের সেই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় এবং ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে পালিত হয় প্রথম ধর্মঘট। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঢাকার সচিবালয় গেট থেকে মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্ররা মুখের ওপর তা প্রত্যাখ্যান করে। মুসলিম লীগ এলিটদের মদদপুষ্ট ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ জিন্নাহকে অন্ধভাবে সমর্থন দেয় এবং সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে মুজিব ও তার সমমনাদের নেতৃত্ব ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মুজিবসহ রাজবন্দিরা পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বরাবর এ মর্মে চিঠি দেন যে, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাকে ও অপর বন্দি মহিউদ্দিন আহমেদকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হলে তারা ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশনে যাবেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে অন্যায়ভাবে দুই বছরেরও অধিক সময় আটকে রাখার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অনশন শুরু করেন। কারাগারে বসেই ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্টভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানো এবং কয়েকজনের শহীদ হওয়ার খবর পান শেখ মুজিব। টানা দশ দিন অনশনের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর কারাগার থেকে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিলাভ করেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই মুজিব টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা যান এবং সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শহীদদের আত্মদানের বিষয়টিকে মুজিব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।
১৯৫২ সালের ৩০ মে সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মুজিব করাচিতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। যেখানে ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত সব বন্দিকে মুক্তির জোর দাবির পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ মিছিলে কেন গুলি চালানো হলো সে বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও কথা বলেন শেখ মুজিব।
পরবর্তী বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে প্রথম শহীদ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিন নয়। বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান, অধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ নির্মাণের আন্দোলনের প্রতীক।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা। স্বাধিকার পথ বেয়েই আসে স্বাধীনতা। যার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা। সে কারণেই বলা হয়, বাংলাদেশের অপর নাম বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সহ সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরিষাবাড়ী উপজেলা শাখা জামালপুর ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।
আজসারাবেলা/সংবাদ/রই/কলাম