ডা. অভিজিৎ চৌধুরী। বাংলাদেশী চিকিৎসক। পিএইচডি গবেষণা করছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে সহযোগী প্রভাষক হিসেবেও কর্মরত তিনি। সম্প্রতি ফ্যাকাল্টি অফ হেলথ এন্ড মেডিসিন থেকে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থ্রি মিনিট থিসিস’ প্রতিযোগিতার ফাইনালে পৌঁছান অভিজিৎ। চট্টগ্রামের এই তরুণ একইসঙ্গে চিকিৎসক, গবেষক ও শিক্ষকের ভূমিকায় ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত এই মেধাবী, আলোকিত মুখ মুখোমুখি হয়েছিলেন আজ সারাবেলা’র। কথা হয় বিদেশে পড়াশোনা, গবেষণার সুযোগ, পাশাপাশি ক্যারিয়ার গড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে। দেশের বাইরে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য এই সাক্ষাৎকার অনেকটা টনিকের মতো…।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন।
আজ সারাবেলা: থ্রি মিনিট থিসিস প্রতিযোগিতায় আপনার অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা যদি বলেন।
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: থ্রি মিনিট থিসিস একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্রছাত্রীরা তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু তিন মিনিট সময়ের মধ্যে তুলে ধরেন। কি নিয়ে গবেষণা করছেন, কিভাবে করছেন এবং কেন এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি বিষয় প্রতিযোগীরা তুলে ধরেন। প্রতি ফ্যাকাল্টি থেকে বিজয়ী প্রতিযোগীরা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনালে। ফাইনালের চ্যাম্পিয়ন তার বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করেন এশিয়া-প্যাসিফিক ফাইনালে। এ বছর ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন এন্ড পাবলিক হেলথ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনালে যাওয়া তিন প্রতিযোগীর একজন আমি। একই সাথে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টি থেকে ফাইনালে পৌঁছানো প্রথম বাংলাদেশী আমি। আগামী ২৩ শে আগস্ট ফাইনালে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত ১৫ জন প্রতিযোগী লড়বেন শীর্ষস্থানের জন্য। আমার জন্য এই প্রতিযোগিতা মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের কাছে নিজের গবেষণা তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ।
আজ সারাবেলা: আপনি কি নিয়ে গবেষণা করছেন?
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: মানসিক স্বাস্থ্য এবং হাড়ের উপর তার প্রভাব নিয়ে আমি পিএইচডি গবেষণা করছি। আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, দীর্ঘমেয়াদী বিষন্নতা অস্থিক্ষয় এবং হাড় ভাঙ্গার কারণ হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, বিষন্নতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধও করতে পারে অস্থিক্ষয় বা হাড় ভাঙ্গা। আমেরিকা এবং ইউরোপে পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে বিষন্নতা এবং বিষন্নতায় ব্যবহৃত ঔষধ দুটিকেই অস্থিক্ষয় এবং হাড় ভাঙ্গার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এই গবেষণা অপ্রতুল। আমার পিএইচডি সেই ঘাটতি পূরণ করবে বলে আশা রাখি। প্রায় বিশ হাজার অস্ট্রেলিয় নর-নারীর উপর আমি কাজ করেছি।
আজ সারাবেলা: আপনার গবেষণার প্রয়োগ বাংলাদেশে কিভাবে করা যায়?
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা বাংলাদেশে একেবারে শূন্যের কোঠায় বলা যায়। আমাদের দেশে মনের অসুখ নিয়ে কথা বলতে খুব কম মানুষই উৎসাহী হোন। সামাজিক বা পারিবারিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার অভাব খুবই প্রকট। অথচ বাংলাদশের মতো জনবহুল দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভুগছেন মানসিক সমস্যায় এবং সেদিক থেকে বলতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার বিরাট সুযোগ রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী বিষন্নতা এবং উদ্বেগ ডেকে আনতে পারে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং হাঁপানির মতো রোগ। আমি চেষ্টা করছি অস্থিক্ষয় এবং হাড়ভাঙ্গাকে সেই তালিকায় যুক্ত করার। এই সবক’টি অসুখই বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। আমরা আপাতত শুধু এই অসুখগুলোর চিকিৎসাতেই মনোযোগী। কিন্তু এসবের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যব্যয় কমানোর জন্য যে মানের গবেষণার প্রয়োজন তার ক্ষেত্র বাংলাদেশে এখনো অপ্রতুল। আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় গবেষণার উপর কোন জোর দেয়া হয় না। এই অবস্থার পরিবর্তন খুবই জরুরী।
সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সমন্বয় গড়ে তোলার মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসকেরা এই গবেষণায় এগিয়ে আসতে পারেন। তবে এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা। একই সাথে চিকিৎসকদের গবেষণা করার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও নিতে হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে এক সাথে কাজ করতে আগ্রহী হবে। বাংলাদেশ যে কোন স্বাস্থ্য গবেষণার অতি উর্বর ক্ষেত্র হতে পারে। তবে তার জন্য আগে প্রয়োজন জাতি হিসেবে আমাদের সদিচ্ছা এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরী করা।
আজ সারাবেলা: আপনার পিএইচডির অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি বলেন।
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে এসে প্রচুর শিখছি আমি। আমার পিএইচডি তত্তাবধায়কেরা আমার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল। কাজে প্রচুর উৎসাহ এবং প্রশংসা পাই। কোন ভুল করলেও সমালোচনা না করে সেই ভুলটা কেন হলো সেটা শিখতে উৎসাহিত করা হয়। এখানে শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মানের চোখে দেখেন। শিক্ষকদের প্রতি কোন ভয় এখানে কাজ করে না। শিক্ষকের দিকনির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহিত করা হয় প্রচুর। নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা ভিত্তিক লেখা ও কথা বলার মান বাড়াতে প্রচুর প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। এগুলোতে অংশ নিয়ে খুবই লাভবান হয়েছি। অনেক দেশের অনেক মানুষের সাথে মিশে হৃদ্ধ হয়েছি। পিএইচডি ছাত্র হিসেবে যোগ দেবার পর থেকে আমি প্রতি বছরই এক বা একাধিক স্কলারশিপ পুরষ্কার পেয়েছি। ২০১৫ তে পিএইচডি ভর্তি নিশ্চিত হবার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ছয়টি স্ক্লারশিপ পুরষ্কার পেয়েছি। এটি আমার জন্য খুবই আনন্দের একটি অভিজ্ঞতা। পিএইচডি আমাকে ভবিষ্যতের একজন আন্তর্জাতিক মানের জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে গড়ে তুলছে।
আজ সারাবেলা: পিএইচডি ছাত্র থাকাকালীন কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন?
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য খুবই আনন্দের একটি অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সালে পিএইচডি শুরু করার পর মাত্র আড়াই বছরের মাথায় আমি মেডিকেল এডুকেশনের সহযোগী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেই ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে। তবে এ জন্য আমি সময়ের সাথে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। ২০১৮ সালে মেডিসিন ফ্যাকাল্টি থেকে এক বছর মেয়াদী টিচিং এন্ড লার্নিং স্কলারশিপ পাই। এই স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম বাংলাদেশী আমি। এই স্কলারশিপের আওতায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার উপর তিনটি প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করি। একই সাথে পুরো ২০১৮ সাল জুড়ে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়েন্ট মেডিক্যাল প্রোগ্রামের আওতায় শিক্ষকতা করি। প্রচুর শেখার সুযোগ হয়েছে আমার এই সময়। আমি উপলব্ধি করেছি কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষা পিছিয়ে আছে। একই বছরে মেডিকেল এডুকেশনের সহযোগী প্রভাষক হিসেবে চাকরির আবেদন করি এবং সফল হই। শুধুমাত্র গবেষণায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে পেশাগত বিভিন্ন সুযোগের জন্য সবসময় উন্মুখ থাকি। মূলত এটিই পিএইচডি ছাত্র অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার এক অনন্য সুযোগ তৈরী করেছিল আমার জন্য।
আজ সারাবেলা: অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করতে চান এমন বাংলাদেশী চিকিৎসকদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: প্রথমেই দরকার গবেষণায় অভিজ্ঞতা এবং কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা। ছাত্র অবস্থা থেকেই এতে মনোযোগী হওয়া উচিত। একই সঙ্গে খুঁজে বের করতে হবে একজন যোগ্য পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক। পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক মানুষ হিসেবে কেমন তার উপর নির্ভর করে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পিএইচডিতে সাফল্য লাভের সম্ভাবনা। সাহসী হতে হবে, যেকোন পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহন করতে হবে। ইংরেজি ভাষার উপর ভালো দখল এবং নেটওয়ার্কিং করতে হবে প্রচুর। সাবলীল নেটওয়ার্কিং থেকেই ভবিষ্যতে বড় বড় সুযোগগুলো আসবে। আজকের যুগে গবেষণা মানে শুধু মুখ গুজে পড়াশুনা করা নয়। নিজের ব্যক্তিত্ব এবং নিজের কাজকে সুন্দরভাবে অন্যের সামনে তুলে ধরতে হবে। একজন ভালো লেখকের পাশাপাশি, একজন গবেষককে হতে হবে সুবক্তা এবং সর্বোপরি একজন সৎ মানুষ।
আজ সারাবেলা: চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক ভবিষ্যতে কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে চান আপনি?
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: আমি তিনটি পরিচয়ই ধরে রাখতে চাই। অস্ট্রেলিয়ায় পোর্টফলিও ক্যারিয়ার খুবই জনপ্রিয়। সারাজীবন একই কাজ না করে বৈচিত্রপূর্ণ একটি ক্যারিয়ার পেতে আমি আগ্রহী। তবে সেটি নির্ভর করবে ভবিষ্যতে আসা সু্যোগের উপর। আমি নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন স্নাতক পর্যায়ের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়াই। পিএচডি শেষে আমি স্নাতোকত্বর জনস্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাবার ব্যাপারে আশাবাদী। একই সাথে আমি মানসিক স্বাস্থ্য ও ডায়াবেটিস বিষয়ে গবেষণায় যুক্ত থাকতে চাই। সর্বোপরি একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি অস্ট্রেলিয়ায় নিতে চাই উচ্চতর প্রশিক্ষণ।
আজ সারাবেলা: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য।
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী: আজ সারাবেলা’কেও ধন্যবাদ।
আজসারাবেলা/সংবাদ/রই/সাক্ষাৎকার/প্রবাস