প্রতিকূল সময়েও বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে যদি বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হতে হয় তা আমি হবো: বিপ্লব সরকার

0
1437

বিপ্লব সরকার। ২৪ বারের শ্রেষ্ঠ ডিসি ডিএমপির। পুলিশ বিভাগে ‘হিরো’ বলে যার খ্যাতি। সৎ, মেধাবী, পরিশ্রমী। জনবান্ধব হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার। রাজধানীর বড় একটি অংশজুড়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে জানতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। চান আগামী প্রজন্ম ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে জানবার মধ্যদিয়ে এক আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। ‘ইতিহাসের আলো’র এই ফেরিওয়ালা মুখোমুখি হয়েছিলেন আজ সারাবেলা’র।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন
[এই সাক্ষাৎকার গ্রহনের মাত্র ক’দিন পরই বিপ্লব সরকারকে এক সরকারি আদেশে বদলি করা হয় ঢাকার বাইরে, সুদূর রংপুরে। প্রতিযোগিতা কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়ে যাবার পরও থেকে যায় অসমাপ্ত]

আজ সারাবেলা: বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম জানবার জন্য ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের পক্ষ থেকে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। এই আয়োজনের প্রেক্ষাপট যদি বলেন?

বিপ্লব সরকার: আমাদের যাদের জন্ম ’৭১ বা ’৭২ এ, তাদের মানসপটে বঙ্গবন্ধুর কোন ছবি ছিল না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে দেওয়া হয়নি। অনেকটা নিষিদ্ধ নাম ছিলেন তিনি। এই চিত্রটি ’৯৬ এর আগ পর্যন্ত। তখন আমাদের বয়স প্রায় ২৪ অথবা ২৫। যতটুকু জেনেছি তা নেহাত পারিবারিক পর্যায়ে আর অল্পকিছু লেখালেখির মাধ্যমে। ’৯৬ পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে জানাবার সুযোগ তৈরী হয়। কিন্তু সত্যিকার দেশপ্রেমী, মানবিক, নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে শিশুদের বঙ্গবন্ধুর জীবন পাঠের বিকল্প নেই। কী সীমাহীন ভালোবাসা, সংগ্রাম আর আত্নত্যাগের বিনিময়ে একজন মানুষ শুধু মানুষকে ভালোবেসে দেশ ও জাতি গঠন করে গেছেন। কত নির্যাতনই না তাকে সইতে হয়েছে। অথচ নীতির প্রশ্নে, সততার প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে কখনও আপোষ করেননি তিনি।

জানতে হবে, জানাতে হবে প্রকৃত সত্য। এখানে অর্ধসত্য বা মিথ্যার কোন সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস এবং প্রকৃতি বড় ভয়ংকর, ছাড় দেয় না কাউকেই। শত বছর পর হলেও সত্য প্রকাশিত হয়।

আমরা বরাবরই বই বিমুখ জাতি। বই পড়তে আমাদের অনীহা, ইতিহাস জানতে অনাগ্রহ। অন্যান্য দেশে গেলে দেখা যায়, বাসে-ট্রেনে লোকে যাচ্ছে- হাতে বই। অথচ এখানে এই দৃশ্য বিরল। ফলে অপপ্রচার, অর্ধসত্য, মিথ্যা সহজেই জায়গা করে নেয়। আমরা সারাক্ষণ ফেসবুকে, অথচ সেখানে মিথ্যা, ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি। প্রকৃত সত্য না জানবার কারণেই কোন প্রতিবাদ নেই। আমরা চেয়েছি শিশু-কিশোররা বই পড়–ক। সত্য জানুক। এই প্রজন্ম ইতিহাসের শিকড় সন্ধান করুক। তাই তেজগাঁও বিভাগ বই পড়ার এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। যার কৃতিত্ব আমার একার নয়, আমাদের তেজগাঁও বিভাগের সবার।

আজ সারাবেলা: বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিনও পালন করেছেন শিশুদের নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে।

বিপ্লব সরকার: বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আমরা চেয়েছি অনাথ শিশুদের নিয়ে একটা দিন কাটাতে তাদের একটি আনন্দময় দিন উপহার দিতে। ঢাকায় অনেক দরিদ্র পথশিশু রয়েছে কিন্তু আমরা টাঙ্গাইলের একটি অর্ফানেজ থেকে প্রায় ১২৫ জন শিশুকে নিয়ে এসেছিলাম। ঢাকার একজন দরিদ্র শিশু তুলনামূলকভাবে প্রিভিলেজ। সে হয়তো কোন না কোনভাবে সাহায্য সহযোগিতা বা দাওয়াত পায় কখনও কখনও। কিন্তু দরিদ্রের মধ্যে যে দরিদ্রতম, মফস্বলের অনাথ বঞ্চিত চেয়েছি তাদের একটা দিন একটু আনন্দ দিতে। পোশাক, উপহার সামগ্রি বিতরণ, উন্নত খাবার পরিবেশন, শিশুমেলায় বেড়ানোর পাশাপাশি তাদের নিয়ে গিয়েছি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে- বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। এই শিশুরা হয়তো প্রকৃত সত্য না জেনে বা ভুল জেনে বড় হতো। কিন্তু আমরা চেয়েছি এই অনাথ শিশুরাও সত্যকে জানুক। কারা, কিভাবে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারা তা উপলব্ধি করুক।

আজ সারাবেলা: বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্থপতি। কিন্তু এখানে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র রয়েই গেছে। যদি আপনাকে ‘আওয়ামী পুলিশ’ হিসেবে লেভেলিং করা হয় সেই ঝুঁকিওতো থেকে যায়। কি উত্তর দিবেন আপনি?

বিপ্লব সরকার: বঙ্গবন্ধু কিন্তু শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নয়। বাঙালি জাতির। আমার অনুভূতির জায়গা থেকে যদি বলি, বঙ্গবন্ধুকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মনে করি না। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, বাংলাদেশের জাতির পিতা। আওয়ামী লীগের একার নয়। এখানে কেউ যদি উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে সংকীর্ণ মনোভঙ্গি নিয়ে আমাকে ‘আওয়ামী’ হিসেবে ট্যাগিং করতে চায় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই।
মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আরেক প্রতিশব্দ। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, অমুক পার্টি, তমুক পার্টিতো খুব ক্ষুদ্র বিষয়। বঙ্গবন্ধু অনেক বড়। তাকে জানতে শেখা, জানাতে শেখাতো দেশকেই ভালোবেসে জানা। মাটি মানুষকে বোঝা।

আজ সারাবেলা: আপনি বলছেন কেউ যেন আপনাকে আওয়ামী সমর্থিত পুলিশ হিসেবে বিবেচনায় না নেয়। কিন্তু আপনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ গবেষণা সংগঠন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছেন। যে সংগঠনটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মোহাম্মদ এ আরাফাত।

বিপ্লব সরকার: আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি বিধি মোতাবেক আমার কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে না। কোন অবস্থাতেই পারে না। এবং অবশ্যই আমার কোন ধরনের সম্পৃক্ততা নেইও। আমি কোন রাজনীতি করি না। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সুচিন্তার একটি অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছি। কিন্তু সেটি কিসের অনুষ্ঠান ছিল? ‘জাগো তারুণ্য রুখো জঙ্গিবাদ’। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সুচিন্তার যে নিয়মিত কার্যক্রম সেখানে অংশ নিয়েছি। জঙ্গিবাদের যে ভয়াল থাবা তার কিয়দংশ আমরা দেখেছি হলিআর্টিজানে হামলার মধ্যদিয়ে। আমি যেমন একজন সরকারি কর্মকর্তা তেমনি সমাজেরই একজন মানুষ। সমাজের একজন মানুষ হিসাবে আমার দায়িত্ব রয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয়া।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে একটি প্লাটফর্মে আসতে বলেছেন। আমার দশ মিনিটের বক্তৃতা একজন ছাত্রকেও যদি মোটিভেট করে, সেটাই স্বার্থকতা। যারা সুচিন্তার এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়াকে খণ্ডিতভাবে দেখছে তাদের একধরনের শিক্ষাগত, মানসিক এবং সাংস্কৃতিক দৈন্যতা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, চাকরি আগে না দেশ আগে? দেশ যদি জঙ্গিদের দখলে চলে যায়, দেশ যদি না থাকে তাহলে চাকরি করা আর না করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

আজ সারাবেলা: আপনি কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের বঙ্গবন্ধুর জীবন জানতে অনুপ্রানিত করছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের কোন দিকটি আপনার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, স্পর্শ করে একই সঙ্গে?

বিপ্লব সরকার: ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আজকের দিনে সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা কে কিভাবে মন্ত্রী হবে। আর তিনি সেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে দলকে সংগঠিত করবার জন্য দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই যে সেক্রিফাইজ তা কিন্তু এমনি এমনি নয়, এর পিছনে একটি লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল।
নিশ্চিতভাবেই তার স্বপ্ন ছিল দেশটাকে স্বাধীন করা। তার আলটিমেট গোলই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রত্যেকেই বড় নেতা ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুরও নেতা ছিলেন। তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও মান্যতা ছিল বরাবরই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের বাংলাদেশে ক’জন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, ফজলুল হক’কে স্মরণ করেন। শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সে অর্থে তাদের কোন সংগঠন না থাকার কারণে মানুষ আজ তাদের ভুলতে বসেছে। আজকে আওয়ামী লীগ আছে বলেই বঙ্গবন্ধু আছেন। তিনি যে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেটা তার পরিকল্পনারই অংশ ছিল। তিনি মানুষকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। আর বাঙালির মুক্তির জন্য সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী’ পড়লে বোঝা যায়, তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সবসময়ই।

৭ই মার্চ প্রকারন্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাঙালিকে যা বলার তা বলে দিয়েছিলেন। তার কাছে ছোট বড় সবাই সমান ছিলেন। দূর্দান্ত সাংগঠনিক ছিলেন। আর সবচেয়ে বড়গুণ মানুষকে ভালোবাসতে জানতেন। তার সবই আমাকে আর্কষণ করে।

আজ সারাবেলা: আপনি যে এলাকার দায়িত্বে আছেন, বলা হতো তেজগাঁও জোন বিএনপি’র ঘাটি; এই প্রতিযোগিতার পেছনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। আপনার মতামত কী?

বিপ্লব সরকার: রমনা-তেজগাঁও আসনে বঙ্গবন্ধু এমপি ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও ছিলেন। এখন এমপি আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি কর্মীবান্ধব, জনবান্ধব একজন সাদা মনের মানুষ। এটা সর্বজনবিদিত। মানুষ যাকে যোগ্য মনে করবেন, ভালোবাসবেন তাকেই ভোট দিবেন।
আমি শুধু আপনাকে এইটুকু নিশ্চিত করতে চাই, এই প্রতিযোগিতার পেছনে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।
বঙ্গবন্ধুইতো বাংলাদেশ, তাকে না জানার কোন সুযোগ নেই। নিজের পরিচয় জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে।

আজ সারাবেলা: এই সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রয়েছে। কোন দলীয় সরকারই সবসময় ক্ষমতায় থাকবে এমন নয়। আপনি সরকারি কর্মকর্তা। কোন কারণে যদি সরকারের পরিবর্তন ঘটে তাহলে আপনার এই কার্যক্রম ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে। সেই ঝুঁিক আপনি কতটা বোধ করেন?

বিপ্লব সরকার: বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে এদেশের বহুলোক নির্যাতিত, নিপীড়িত, বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি নিষিদ্ধ নাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি আবৃত্তির মধ্যদিয়ে বাঙালির মানসপটে বঙ্গবন্ধুকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন। আমরাতো তাদেরই উত্তরসূরী।

যদি ব্যক্তি বিপ্লবের কথা বলেন, সবার আগে আমি মানুষ। আমার কাছে সত্যের চেয়ে বড় কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে সেই ছাত্রজীবনেইতো শরীরের রক্ত ঝড়িয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি। শুধু অনুকুল সময় কেন, যেকোনো প্রতিকূল সময়েও বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে যদি বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হতে হয় তা আমি হবো। দেশের জন্য জীবন দিতেও আমি প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধুতো আমার কাছে দেশই।

পুলিশেতো এসেছিই জীবনের মায়া ত্যাগ করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াঁবো, মানুষের সেবা করবো বলে। আমার কাছে মানবতা, মানুষ আর দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই।

আজসারাবেলা/সংবাদ/রই/সাক্ষাৎকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here